সময়ের চাহিদায় SME ও স্টার্টআপে আইটি সাপোর্ট

এই যুগে টাকার থেকেও দামি হচ্ছে সময়, আর সময় বাঁচাতে চাই প্রযুক্তি। আজকাল যেকোনো কাজেই মানুষ চায় দ্রুত সমাধান। ব্যাবসা-বাণিজ্যও তার বাইরে নয়। এমনকি শহরের অলিগলির ছোটো দোকানদারও এখন বিকাশ বা নগদের কিউআর কোডে পেমেন্ট নেয়। সময় বদলেছে, প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে, কিন্তু সমস্যা একটাই—সবাই জানে না কীভাবে প্রযুক্তিকে কাজে লাগাবে। সবার হাতে নেই সঠিক দিক-নির্দেশনা।


বর্তমান প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে SME—Small and Medium Enterprises অর্থাৎ ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলো। একই সাথে আলোচনায় আসে স্টার্টআপ—যারা নতুন কোনো পণ্য বা সেবা নিয়ে প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাবসার সূচনা করে। এসব প্রতিষ্ঠান দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসাবে বিবেচিত হলেও, অনেক সময় প্রযুক্তিগত দুর্বলতার কারণে তারা পিছিয়ে পড়ে। উদ্যোক্তাদের বড়ো একটি অংশ জানে না কীভাবে ডিজিটাল সল্যুশন বা আইটি সাপোর্ট ব্যবহার করে তাদের ব্যাবসায়িক কার্যক্রমকে আরও দক্ষ ও সময় সাশ্রয়ী করা যায়।


এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছে দেশের তরুণ উদ্যোক্তারা। একটি ভালো আইডিয়া থাকলেও সেটিকে ব্যবসায় বাস্তব রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা বারবার হোঁচট খায়। কারণ তারা জানে না কোন পর্যায়ে কী ধরনের প্রযুক্তি দরকার, কীভাবে করপোরেট কাঠামো গড়তে হয় কিংবা কোথা থেকে সহায়তা নিতে হবে?
অনেকেই মনে করেন, ব্যাবসা মানেই শুধু পণ্য বা সেবা বিক্রি। কিন্তু বাস্তবে একটি ব্যাবসার টেকসই ভিত্তি গড়ে ওঠে তথ্যপ্রযুক্তির (আইটি) সাপোর্ট, আইনগত কাঠামো, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং ডিজিটাল ব্র্যান্ডিংয়ের ওপর। এসব জায়গায় দুর্বলতা থাকলে, সর্বোত্তম পণ্য বা সেবাও বাজারে টিকে থাকতে পারে না।


একটি ছোটো স্টার্টআপ যাত্রা শুরু করে সীমিত বাজেট আর অল্প রিসোর্স নিয়ে। কিন্তু তার সামনে থাকে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ। এই পর্যায়ে তাদের প্রয়োজন এমন একজন সহযোগীর, যে শুধু সফটওয়্যার ডেভেলপ করে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করবে না, বরং দৈনন্দিন কার্যক্রম, বিপণন, রিক্রুটমেন্ট এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনাসহ পুরো পরিকল্পনাকেই গাইড করবে।
আজকের তরুণেরা সাহসী, উদ্ভাবনী এবং ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। কিন্তু যখন তারা চিন্তা করে—আমার আইডিয়াটা ভালো, কিন্তু সামনে কে দাঁড়াবে? তখন দেখা দেয় সমস্যার আসল রূপ। অনেকেই জানেন না কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন কোথায় করাতে হয়, ওয়েবসাইট বা অ্যাপ কীভাবে এবং কার মাধ্যমে তৈরি করাতে হবে, ট্যাক্স ও ভ্যাট কীভাবে হিসাব করতে হবে বা টিম গঠনের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই চলে যায় অমূল্য সময়, তৈরি হয় দুশ্চিন্তা এবং অর্থের অপচয়। অনেকে ভুল জায়গা থেকে সেবা নিয়ে আরও বিপদে পড়েন। এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন এমন একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম, যেখান থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা, করপোরেট কাঠামোর দিক-নির্দেশনা এবং টিম ম্যানেজমেন্টের পরামর্শ—সবই পাওয়া যায় এক জায়গায়।


সরকারি পর্যায়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (BSCIC), যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের রেজিস্ট্রেশন, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং শিল্প প্লট বরাদ্দের মাধ্যমে সহায়তা করে। বেসিক এর বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২৩-২০২৪ অনুযায়ী, প্রযুক্তি বিভাগের আওতায় ১৫টি দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণকেন্দ্র কর্তৃক তিন হাজার ৪৭৯জনকে এবং স্বল্প মেয়াদী দক্ষতা প্রশিক্ষণে ৭৫০জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও উদ্যোক্তাদের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপনে অবকাঠামোগত সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৮২টি শিল্পনগরী স্থাপিত হয়েছে, যেখানে তিন লাখ ২২ হাজার ৯৭জন পুরুষ ও তিন লাখ সাত হাজার ৬৭৯জন মহিলা কর্মরত। দেশের গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলে শিল্প বিকাশে BSCIC-এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কার্যক্রম উদ্যোক্তাদের জন্য একটি শক্ত ভিত তৈরি করছে।
এছাড়াও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (BIDA) স্টার্টআপ ও SME উদ্যোক্তাদের জন্য বিনিয়োগ সংক্রান্ত পরামর্শ, অনুমোদন এবং (One Stop Service, OSS) পোর্টালের প্রায় ১২৪টি সেবার মাধ্যমে ৪১টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য এক প্ল্যাটফর্মে সংযুক্ত করে সময়োপযোগী ও স্বচ্ছ সেবা করে আসছে। আইটি খাতসহ সম্ভাবনাময় সেক্টরগুলোতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করাও BIDA-এর একটি মূল লক্ষ্য।


সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও সময়োপযোগী আইটি সাপোর্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যেমন: ২০২৫ সালে FounderSheba.com দেশের আইটি খাতের তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে দৃশ্যমান আগ্রহ তৈরি করেছে। এটি এমন একটি ‘ওয়ান-স্টপ’ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে উদ্যোক্তারা সহজেই আইনগত সহায়তা, ট্যাক্স ব্যবস্থাপনা, রিক্রুটমেন্ট এবং আইটি স্ট্রাকচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোতে পরামর্শ ও সমাধান পাচ্ছেন—যা তাঁদের ব্যবসায়িক যাত্রাকে আরও সুসংগঠিত ও সফল করে তুলতে ভূমিকা রাখছে। DeshiCommerce দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ও পূর্ণাঙ্গ ই-কমার্স সল্যুশন প্রদান করছে। ইতোমধ্যে সারাদেশে প্রায় ৭০টির বেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এ সেবা ব্যবহার করছে। অপরদিকে weDevs স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক স্টার্টআপদের জন্য বিজনেস সফটওয়্যার, মোবাইল অ্যাপ ও ক্লাউড সল্যুশন সরবরাহ করে, যাদের WPERP সফটওয়্যার বর্তমানে ১০ হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশ যদি আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতির দিকে এগোতে চায়, তাহলে SME ও স্টার্টআপ খাতকে প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিশালী করতে হবে। এখান থেকেই তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থান, উদ্ভাবনী পণ্য, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সক্ষমতা এবং বৈদেশিক আয়।


এক সময় কেউ ব্যাবসা শুরু করলে প্রথমেই ভাবতো পুঁজির কথা। এখন যুগ পাল্টেছে। আজকের দিনে সঠিক গাইডলাইন ও টেক সাপোর্ট না থাকলে পুঁজি থাকা সত্ত্বেও ব্যর্থতার সম্ভাবনা থাকে বেশি। তরুণদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে হলে সরকারি ও বেসরকারি সহায়তাই হতে পারে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক শক্তি। কারণ যেখানে স্বপ্ন তৈরি হয়, সেখানেই যদি সঠিক সহযাত্রী না থাকে, তাহলে সম্ভাবনার চাকা থেমে যায়। কিন্তু যদি সঠিক দিক-নির্দেশনা, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পাওয়া যায়, তাহলে একটি ছোটো আইডিয়াও একদিন হয়ে উঠতে পারে একটি বড়ো উদ্ভাবন। আর এই উদ্ভাবনই হতে পারে আগামীর কর্মসংস্থান, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং একটি আত্মনির্ভর বাংলাদেশের ভিত্তি।

আল রুবাইয়াত, কম্পিউটার প্রকৌশলী, আইটি উদ্যোক্তা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *